সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৫:০০ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
জনগণ যাকে ভালবাসবে, দায়িত্ব দিতে চাইবে, তাকেই দেবে- জেলা প্রশাসক বাহুবলে বিয়ের আনন্দ-ফুর্তি চলাকালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে যুবতীর মুত্যু বাহুবল উপজেলা নির্বাচন : ২০ প্রার্থীর মাঝে নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ বাহুবল উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা অনুষ্ঠিত বাহুবলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ বাহুবল হাসপাতালের নতুন ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রথম সভা বাহুবলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের বাছাইয়ে দুই প্রার্থীর মনোনয়নপত্র অবৈধ বাহুবল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ২০ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল শিশুদের বিবাদের জেরে আজমিরীগঞ্জে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ৩৫ দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর

সড়ক পরিবহন আইন হোক সুসংহত ও প্রায়োগিক

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সড়ক দুর্ঘটনা একটি মারাত্মক সমস্যা। প্রতিনিয়তই দেশের নানা প্রান্তে বিক্ষিপ্তভাবে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য পথচারী। যার হিসাবে রয়েছে শিশু সহ প্রাপ্ত বয়স্করাও। এতসব মৃত্যুর পেছনে দায়ী আত্ম সচেতনতা ও উদাসীনতা। তবে মূল সমাধান সচেতনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের সড়কগুলোতে নেশাগ্রস্থ হয়ে ঘুমন্ত চোখে বা বেপরোয়াভাবে চালকদের গাড়ি চালানোর যে প্রবণতা তাই শতভাগ দায়ী। সরকারের প্রতিটি বাজেটে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অবকাঠামোর উন্নয়নের মধ্যে সড়ক খাতে মোটা অংক বরাদ্দ থাকে। দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক ইতোমধ্যেই চারলেনে রুপান্তরিত হয়েছে। এছাড়া প্রস্তাবিত সড়কগুলোকেও এ পর্যায়ে নিয়ে আসতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষ দ্রুতই কাজ করে যাচ্ছে। দুর্ঘটনা নিরসনের লক্ষ্যে সড়ক ব্যবস্থায় এমন অভুতপূর্ব উন্নয়ন হওয়ার পরেও কেন এত দুর্ঘটনা ঘটছে? আর এর সমাধানই বা কোথায়?
গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের জাবালে নূর পরিবহনের বাস চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হন। পরের দিন রাজধানীর সড়কে অবস্থান করে বেপরোয়া বাস চালকের ফাঁসি, রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালনা বন্ধসহ ৯ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। বেশ কয়দিন তারা অব্যাহত রেখেছিলেন এই আন্দোলন। তাদের এই আন্দোলনের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করতে শুরু করেছিল। আন্দোলনের চাপের মুখে সরকার মহল শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনকে ও দাবিকে যৌক্তিক বলে স্বীকার করেছিলেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নিজেরাই গাড়ির চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স সঠিক আছে কি না বা মেয়াদোত্তীর্ণ কি না পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে দেখেছেন। তাদের এমন সচেতনতাবোধ ও রাস্তায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে মাঠে নেমে যেসব কর্মকাণ্ড দেখিয়েছেন তা সর্ব মহলে গ্রহণযোগ্য ও সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। অথচ এই আন্দোলনকারী কোন এক ছাত্রীকে ধর্ষণসহ সকল আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের উপর ছাত্রলীগের কর্মীদের মারধর করার মত বর্বর আচরণ করার অভিযোগও উঠেছে। পরবর্তীতে তাদের দাবিগুলোকে আমলে নিয়ে এ সংক্রান্ত একটি নতুন আইন তৈরি করা হয়। গত ৬ আগস্ট মন্ত্রীসভার বৈঠকে এই আইনকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে যা ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ নামে পরিচিত। তবে এই আইনে সাধারণ জনগণ ও পথচারীদের আশা ও প্রত্যাশার সঠিক প্রতিফলন ঘটেনি বলে বিভিন্ন মহল মন্তব্য করেছেন। জেনে নেয়া যাক নতুন এই আইনে কি কি রয়েছে।
নতুন আইন অনুযায়ী বেপরোয়াভাবে বা অবহেলা করে গাড়ি চালানোর কারণে কেউ আহত বা নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩০৪ (খ) ধারায় মামলা দায়ের হবে। আর এই ধারায় সাজা সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। বর্তমান এই আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে।
তবে গাড়ি চালানোর কারণে কারো নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তে হত্যা প্রমাণিত হলে ফৌজদারি আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রয়োগ হতে পারে।
খসড়া আইন আইনুনাযায়ী গাড়ি চালানোর সময় কেউ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। করলে সর্বোচ্চ একমাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা বা উভয়দণ্ডের বিধান রয়েছে। সড়কের ফুটপাতের ওপর দিয়ে কোন ধরণের মোটরযান চলাচল করতে পারবে না। করলে তিন মাসের কারাদণ্ড বা ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে। আগে গাড়ি চালকদের লেখাপড়ার বিষয়ে কিছু না থাকলেও নতুন আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণী পাস হতে হবে। কনডাক্টর বা চালকের সহযোগীকে কমপক্ষে লেখা ও পড়ার সক্ষমতাসহ পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা থাকতে হবে। নতুন আইনে গাড়ি চালানোর অপেশাদার লাইসেন্স পেতে হলে অষ্টম শ্রেণী পাস ও বয়স ১৮ বছর হতে হবে। পেশাদার লাইসেন্সের জন্য ২১ বছর হতে হবে। যদি কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালায় তবে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কেউ এই অপরাধ করলে তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা করা যাবে। চালকের সহকারীরও লাইসেন্স থাকতে হবে। লাইসেন্স না থাকলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে। এছাড়া জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহার করলে পূর্বে শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা। নতুন আইনে মূল শাস্তির কারাদণ্ড আগের মত থাকলেও জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে। ফিটনেস না থাকা মোটরযান চালালে পূর্বের শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা। তবে নতুন আইনে শাস্তি সর্বোচ্চ এক বছর ও এক লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। এ শাস্তি পাবেন মূলত গাড়ির মালিক। এছাড়াও লাইসেন্সে ১২ টি পয়েন্ট থাকবে। অপরাধ অনুযায়ী পয়েন্ট কর্তন করা হবে। এভাবে ১২ পয়েন্ট শেষ হলে তিনি আর লাইসেন্স পাবেন না।
এত সব কঠিন আইন তৈরির করার পরও কি সড়কে মৃত্যুর হার কমে গেছে? কমে নি বরং সেটা আগের মতই চলমান রয়েছে। আমরা প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকা ও প্রতিটি টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ আকারে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সড়কে মৃত্যুর খবর পাচ্ছি। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে গৃহীত এই আইন কতটা গ্রহণযোগ্য ও প্রয়োগযোগ্য? নীতি নির্ধারকেরা জননিরাপত্তা স্বার্থে হয়ত আইন তৈরি করতে পেরেছেন কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ কেমন সেটাই বিবেচ্য বিষয়। আর নতুন এই আইনে চালক ও মালিক পক্ষ রীতিমত অসন্তুষ্ট। এই আইন মানতে চালক ও মালিকদের এত আপত্তি কোথায়? অপরাধ না করলেই তো হয়! আমাদের ড্রাইভারদের ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন যথোপযুক্ত শিক্ষা। কিন্তু আমাদের ৯০ভাগেরও বেশি ড্রাইভারই মূর্খ। এক রকম অজ্ঞতার কারণেই তারা আইনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীলও হতে পারছে না। আর একমাত্র শিক্ষা, সচেতনতা, সঠিক প্রশিক্ষণের বলে অর্জিত ড্রাইভিং লাইসেন্স ও বিবেকই পারে সড়কে দুর্ঘটনার পরিমাণ প্রায় শুন্যের কোটায় নিয়ে আসতে।
অথচ এই আইনের বিরোধিতায় নেমেছেন এই সব ঘাতক চালক, তাদের সহযোগী ও মালিকেরা। এই আইনে তাদের বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর স্বাধীনতায় আঘাত পরে যায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন গত ২৮ অক্টোবর দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট পালন করে। ধর্মঘটে সাধারণ জনগণ চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ্যাম্বুলেন্স আটক করা হয়। এতে শিশুসহ বেশ কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে। শুধু তাই নয় তারা ধর্মঘটের সময় কিছু ড্রাইভার পেটের দায়ে গাড়ি নিয়ে বের হলে ঐসব ড্রাইভার ও সাধারণ যাত্রীদের মুখে কালি মেখে দিয়েছিল ধর্মঘট পালনকারীরা যা সভ্য সমাজে কখনও কল্পনা করা যায় না। এমনকি কোন কোন জায়গায় ঐসব ড্রাইভারদের কান ধরে উঠ-বস করানোও হয়েছে। অথচ শ্রমিক ধর্মঘটের সময় বিশ্বের কোথাও এমনটা হতে দেখা যায়নি। এদের বিরুদ্ধে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে। এদেরকে আইনের আওতায় এনে আইনকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। দণ্ডিতদের শাস্তি দেখে হয়ত অন্যসব শ্রমিকদের মধ্য থেকে এই সব নিয়ম বহির্ভূত আচরণ ও সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ হ্রাস পাবে। এই ক্ষেত্রে তারা হবে নিরুৎসাহিত। তাই নিজের, নিজের পরিবারের ও সধারন যাত্রীদের স্বার্থে এই সব ড্রাইভারদের স্লোগান হওয়া উচিৎ -Safe Driving, Saves Lives. তবেই সড়কে ফিরে আসবে শান্তি। পাশাপাশি সড়কে এমন সব অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর হার কমাতে আমরা সাধারণ পথচারীকেও রাস্তা পারাপারে সচেতন হতে হবে। “দেখে শুনি চলি পথ, বাড়ি ফিরি নিরাপদ” এই স্লোগান হোক আমাদেরও অঙ্গীকার।

লেখক-
নাজমুল হোসেন

প্রকৌশলী লেখক ও প্রাবন্ধিক
ই-মেইলঃ nazmulhussen@yahoo.com

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

ওয়েবসাইটের কোন কনটেন্ট অনুমতি ব্যতিত কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
Design & Developed BY ThemesBazar.Com